September 23, 2013

খাঁটি মুসলমান ও কপট মুসলমান

লেখক: আমিন বেগ
To get more articles of writer please click here www.amin-baig.blogspot.com

লোকে বলে, ‘মুসলমান’ দুই প্রকার : খাঁটি মুসলমান ও কপট মুসলমান। খাঁটি মুসলমান তিনি, যিনি ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমান। আর কপট মুসলমান তিনি, যিনি শুধু আদমশুমারির মুসলমান, ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমান নন।
খাঁটি মুসলমানের রয়েছে অনেক বাধা। তিনি পৌত্তলিক হতে পারেন না, ধর্মত্যাগী হতে পারেন না, ধর্ম-বিদ্বেষী হতে পারেন না, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষও হতে পারেন না। সুতরাং এই উদার নৈতিকতার যুগে তার রয়েছে অনেক যন্ত্রণা। আর যেহেতু আদর্শ বিরোধী ও  মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ-বিরোধী কার্যকলাপ তার দ্বারা ঘটানো সম্ভব নয় তাই এই মুসলমানের নাম পড়ে গেছে ‘গোঁড়া মুসলিম’ বা ‘উগ্র মুসলমান’।
পক্ষান্তরে দ্বিতীয় শ্রেণীর ‘মুসলমানে’রা বেশ স্বাধীন! ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে শুরু করে
পৌত্তলিকতা পর্যন্ত কোনো কিছুতেই তাদের বাধা নেই। সুতরাং তাঁদের মধ্যে আছেন-ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম, ধর্ম-বিদ্বেষী মুসলিম, ধর্মত্যাগী মুসলিম, এমনকি পৌত্তলিক মুসলিম!  আর এঁরা যেহেতু পরম উদারতায় বিশ্বাসী এবং যে কোনো মূল্যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিবেশী ব্রাহ্মণ্যবাদের স্বার্থরক্ষায় সদাপ্রস্ত্তত তাই এঁদের উপাধি ‘গুড মুসলিম’ বা ‘উদার মুসলমান’।
পাঠক, সতর্ক থাকুন, পরিভাষার সঠিক মর্মোদ্ধারে যেন গন্ডগোল না হয়। পরিভাষাকে বুঝুন শাস্ত্র দিয়ে, অভিধান দিয়ে নয়। আমরা মনে করি, এক্ষেত্রে আমাদের ‘প্রাচীন’ পরিভাষাই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন।
কুরআন-সুন্নাহয় এ প্রসঙ্গে দু’ টো শব্দ আছে : মুমিন ও মুনাফিক। এ দু’টি পরিভাষা সম্পর্কে শুধু মুমিনরাই নন, মুনাফিকরাও অবগত। নিম্নে এই দুই সম্প্রদায়ের কিছু বৈশিষ্ট্যের উপর আলোকপাত করছি।
১. মুমিনরা ঈমান ও ইসলামকে হৃদয়ে ধারণ করেন। তাই তাদের প্রথম পরিচয় মুসলিম, দ্বিতীয় পরিচয় মুসলিম এবং তৃতীয় পরিচয়ও মুসলিম। ইসলাম ছাড়া তাদের আর কোনো পরিচয় নেই। কারণ ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের রব আল্লাহ, তাদের দ্বীন ইসলাম এবং তাদের রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এতেই তারা সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত। ফলে বাইরের জগতে নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করলেও তারা থাকেন স্থিরচিত্ত। তাদের অন্তরে বিরাজ করে এক স্বর্গীয় প্রশান্তি। যাদের সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘ঈমানের স্বাদ ঐ ব্যক্তি আস্বাদন করেছে, যে সন্তুষ্ট হয়েছে আল্লাহকে রব হিসেবে পেয়ে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে এবং মুহাম্মাদকে রাসূল হিসেবে পেয়ে।’ (সহীহ মুসলিম ১/৪৭, হাদীস : ৩৪)
পক্ষান্তরে মুনাফিকের ঈমান থাকে মুখে। তারা মুমিনদের সাথে সাক্ষাত হলে বলে, ‘আমরা ঈমানদার’। আর  প্রভুদের সাথে মিলিত হলে বলে, ‘আমরা তো আপনাদেরই লোক, ওদের সাথে আমরা খানিকটা কৌতুক করিমাত্র!’
বাহ্যত মনে হয়, সবকিছু তাদের অনুকূলে। তারাও মনে করে, মুসলমানদের আমরা মাত করে দিয়েছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা হল আত্মপ্রবঞ্চিত। আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) তারা প্রতারণা করতে চায় আল্লাহর সাথে ও ঈমানদারদের সাথে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিজেদের সাথেই তারা প্রতারণা করে, কিন্তু তা বোঝে না। (সূরাতুল বাকারা : ৯)
২. মুমিনগণ ভালবাসেন ঈমান ও ইসলামকে  আর ঘৃণা করেন কুফর ও নাফরমানিকে। তাই কোনো অবস্থাতেই তারা পৌত্তলিকতার সাথে আপোষ করতে পারেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“কিন্তু আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে তোমাদের নিকট হৃদয়গ্রাহী করেছেন। আর কুফর, গুনাহ ও অবাধ্যতাকে তোমাদের কাছে ঘৃণ্য বানিয়ে দিয়েছেন। এরূপ লোকেরাই সঠিক পথপ্রাপ্ত, যা আল্লাহর পক্ষ হতে অনুগ্রহ ও নেয়ামতের ফল। আল্লাহ জ্ঞানের মালিক, হেকমতেরও মালিক।” (সূরাতুল হুজুরাত : ৭,৮)
পক্ষান্তরে মুনাফিকরা সর্বশক্তি নিয়োজিত করে ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের বিকাশ রুদ্ধ করার জন্য এবং মুসলিমসমাজে বিজাতীয় কালচার প্রতিষ্ঠার জন্য। দ্বীন ও ঈমান তাদের কাছে নির্বোধ লোকের বৈশিষ্ট্য। উপরন্তু এই সকল অপতৎপরতাকে তারা মনে করে ‘প্রগতিশীলতা’ আর নিজেদেরকে তারা মনে করে ‘প্রগতিশীল’।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যখন তাদেরকে বলা হয়, পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না, তারা বলে, আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী। সাবধান! এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা বোঝে না।
যখন তাদেরকে বলা হয়, যারা ঈমান এনেছে তোমরাও তাদের মতো ঈমান আন, তারা বলে, ঐ সকল নির্বোধ লোক যেরূপ ঈমান এনেছে আমরা কি সেইরূপ ঈমান আনব। সাবধান! এরাই নির্বোধ, কিন্তু তারা জানে না। (সূরাতুল বাকারা : ১১,১২)
৩. মুমিনরা পরস্পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। তাই একজনের ব্যথায় সবাই ব্যথিত হয় এবং একজনের বিপদে সবাই বিপদগ্রস্ত হয়। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই …।” (সূরা হুজুরাত : ১০)
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“মুসলমান মুসলমানের ভাই, সে (নিজেও) তাকে জুলুম করতে পারে না এবং (শত্রুর জুলুমের মুখে) ছেড়েও দিতে পারে না।” (সহীহ বুখারী ২/১০২৮)
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
“পরস্পর প্রীতি, করুণা ও সদ্ভাবে মুমিনগণ যেন একদেহ (একপ্রাণ), যার একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে গোটা দেহ তার জন্য জ্বর ও নিদ্রাহীনতায় আর্তনাদ করে।” (সহীহ বুখারী ২/৮৮৯)
অন্য হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“মুমিনরা সকলে মিলে একটি দেয়ালের মতো, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। এরপর আল্লাহর রাসূল তার আঙুলগুলো প্রবিষ্ট করে দেখালেন।” (সহীহ বুখারী ১/৬৯)
পক্ষান্তরে মুনাফিকরা তাদের প্রভুদের সাথে তাল মিলিয়ে মুমিনদের অভিযুক্ত করে এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশায় পুলক বোধ করে। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“দেখ, তোমরা তো এমন যে, তাদেরকে ভালবাস, কিন্তু তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না। তোমরা তো সমস্ত (আসমানী) কিতাবের উপর ঈমান রাখ, কিন্তু (তাদের অবস্থা এই যে,) তারা যখন তোমাদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, আমরা (কুরআনের উপর) ঈমান এনেছি; আর যখন নিভৃতে চলে যায় তখন তোমাদের প্রতি আক্রোশে নিজেদের আঙুল কামড়ায়। বলে দাও, তোমরা নিজেদের আক্রোশে নিজেরা মর। আল্লাহ অন্তরের গুপ্ত বিষয়ও ভালো করে জানেন। তোমাদের যদি কোনো মঙ্গল হয়,  সেটি তাদেরকে দুঃখিত করে, পক্ষান্তরে তোমাদের মন্দ কিছু ঘটলে তারা খুশি হয়। তোমরা সবর ও তাকওয়া আবলম্বন করলে তাদের চক্রান্ত তোমাদের কিছুমাত্রও ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা কিছু করছে তা সবই আল্লাহর (জ্ঞান ও শক্তির) আওতাভুক্ত।” (সূরা আলেইমরান : ১১৯,১২০)
৪. মুমিন কখনো মুশরিককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে না। কারণ তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সর্বাধিক বিরুদ্ধাচারী। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা,
“যারা আল্লাহ ও আখেরাত দিবসে ঈমান রাখে, তাদেরকে তুমি পাবে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব রাখছে। যদিও বিরুদ্ধাচারীরা হয় তাদের পিতা, বা তাদের পুত্র, বা তাদের ভাই, কিংবা তাদের স্বগোত্রীয়। তাদেরই অন্তরে আল্লাহ ঈমানকে খোদাই করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ হতে এক রূহ (আলো, জিব্রীল আ.) দ্বারা তাদেরকে সাহায্য করেছেন। তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত থাকবে। তাতে তারা সর্বদা থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। তারা আল্লাহর দল। স্মরণ রেখ, আল্লাহর দলই কৃতকার্য হয়।” (সুরাতুল মুজাদালা : ২২)
পক্ষান্তরে মুনাফিকদের অবস্থা এই যে, তারা মুখে মুখে ঈমানের দাবি করে এবং পার্থিব স্বার্থে ধার্মিকতা প্রদর্শন করে। কিন্তু তাদের অন্তরে রয়েছে কুফর। তাদের হৃদ্যতা ও অনুরাগ কাফিরদের সাথেই সংযুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যারা ঈমান এনেছে, তারপর কাফির হয়েছে, তারপর ঈমান এনেছে, তারপর কাফির হয়েছে, তারপর কুফরে অগ্রগামী হতে থেকেছে; আল্লাহ কিছুতেই তাদেরকে ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে পথে আনবেন না। মুনাফিকদের সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য প্রস্ত্তত রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। যারা মুমিনদের পরিবর্তে কাফিরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি তাদের কাছে মর্যাদা খোঁজে? সমস্ত মর্যাদা তো আল্লাহরই কাছে।” (সূরাতুন নিসা : ১৩৭-১৩৯)
অন্য আয়াতে আসমানী কিতাব লাভ করেও যারা মুশরিকদের মিত্রতা কামনা করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“তুমি তাদের অনেককেই দেখছ কাফিরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে। নিশ্চয়ই তারা নিজেদের জন্য যা সামনে পাঠিয়েছে তা অতি মন্দ-কেননা আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তারা সর্বদা আযাবের ভিতরে থাকবে। তারা যদি ঈমান রাখত আল্লাহর প্রতি, নবীর প্রতি এবং যা তাঁর উপর নাযিল হয়েছে তার প্রতি, তাহলে ঐ সকল  লোককে বন্ধু বানাত না। কিন্তু (প্রকৃত বিষয় এই যে,) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য।” (সূরাতুল মায়িদা : ৮০,৮১)
 বর্তমান সময়ে মুমিন-মুনাফিকের বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক। আমাদের মুসলিম দেশগুলোতে দায়িত্বশীলদের নতজানুতা আর সাম্রাজ্যবাদীদের বাধাহীন দৌরাত্ম তা আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এখন মুসলমানদের সম্পদ ও সংস্কৃতি এবং মুসলিম নরনারীর জানমাল ইজ্জত-আব্রু সবচেয়ে মূল্যহীন। আমাদের প্রিয় ভূখন্ডেও দেখছি, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের উদ্ধত দৌরাত্ম। বারবার শুনছি ইসলাম ও ইসলামের নবী সম্পর্কে তাদের প্রকাশ্য কটুক্তি; খবরের কাগজে পড়ছি, মুসলিম তরুণীর আব্রু হারানোর সংবাদ। দেশের সীমান্ত হয়ে গেছে ‘মৃত্যুদেয়াল’। সর্বশেষ এক মুসলিম বাংলাদেশীর ওপর যে বর্বর ও অসভ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে তা বোধ হয় খোদ শয়তানকেও শিহরিত করেছে। কিন্তু এরপরও আমাদের ‘মুসলিম’ দায়িত্বশীলগণ বধিরকর্ণ। তাঁরা প্রতিবেশীর মিত্রতার আশ্বাসে পূর্ণসমর্পিত।
সঙ্গত কারণেই কুরআন মজীদের মুমিন-মুনাফিক প্রসঙ্গটি বারবার মনে পড়ছে।

No comments:

Post a Comment